দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের টকটকে দাবানলে মানব হৃদয় যখন কোদালে আকাশের মতাে ক্লেদজ-তত্ত্বে আর মতবাদে ভরপুর সাহিত্যের শতবিচ্ছিন্ন ধারা, ঠিক তখন সকল বিষােদগারকে দূরে ঠেলে রূপকথার রাজপুত্রের মতাে স্বপ্নের পাখনা মেলে অভিনব ও মৌলিক কথা সাহিত্য নিয়ে এলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০)। পথের পাঁচালী (১৯২৯) বাংলা সহিত্যের সেই স্বতন্ত্র ধারার অগ্রপথিক। মহাকাব্যিক ও মহাআখ্যানধর্মী পথের পাঁচালী উপন্যাসটি তৎকালীন বিচিত্র সাহিত্য পত্রিকায় একযােগে ধারাবাহিকভাবে (১৯৩৫-৩৬) প্রকাশিত হয়। রােমা রােলার Jean christophe -এর সঙ্গে ‘পথের পাঁচালী’র বিশেষ সাদৃশ্য আছে। মূলত আদিম প্রকৃতি-আদিম মানব এবং ভূ-প্রকৃতির সাথে ভূ-মণ্ডলের সাদৃশ্যমূলক বন্ধন আবিষ্কারই উভয় মনীষীর যােগসূত্র। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎ উত্তরযুগের কথা সাহিত্যিকদের মাঝে স্কুলমাস্টার বিভূতিভূষণের অবস্থান স্বতন্ত্র এবং সর্বোচ্চ। শুধু উপন্যাসের জগতে নয়—নিবিড় পাঠকের হৃদয়েও তার স্থান কোমল রজনীগন্ধার স্বরূপ।
প্রথম জীবনে কবিতা লিখতেন। কল্লোল গােষ্ঠি ও পত্রিকার একজন অগ্রগামী সদস্য ছিলেন। কিন্তু পরে তিনি নিজের অন্তরকে চিনে সাহিত্যে কথা-মাধুর্যের সুরভী ছড়ান। মানবজীবনের বিশাল রূপ, উত্থান-পতন, ভাঙা-গড়া-নৈরাশ্যবাদ, চেতনাতন্ত্রের এক সুস্থির চিত্র যেন তাঁর প্রতিটি উপন্যাস। তবে নৈরাশ্যবাদকে ছাড়িয়ে অলােকের জগতে, স্বপ্নীল আভাযুক্ত জগতে প্রবেশ করান তাঁর প্রত্যেক পাঠককে। প্রখ্যাত সমালােচক ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তার বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত গ্রন্থের (৫৬০ পৃ) বিভূতিভূষণ ও তাঁর কথা সাহিত্য সম্বন্ধে বলেন—“দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইয়ােরােপীয় উপন্যাসের রচনারীতি ও আঙ্গিকগত কত বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে, তা পাঠক-পাঠিকা অবগত আছেন। সে দিক থেকে বিভূতিভূষণের উপন্যাস রচনার রীতিটি নতুন প্রকরণ বলেই অভিনন্দনের যােগ্য। চরিত্র, ঘটনা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, তাত্ত্বিক সংঘাত, সামাজিক প্রশ্ন,-তাঁর উপন্যাসে এসবের বিশেষ বাহুল্য নেই। আছে চেনা পৃথিবীর মধ্যে, পরিচিত মানুষের মধ্যে, দৈনন্দিক জীবন ধারণের মধ্যে, অচেনা অরূপ জগতের মধ্যে সৌন্দর্যময় ইঙ্গিত, রহস্যময় ব্যঞ্জনা। সে দিক থেকে বিভূতিভূষণ শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্বসাহিত্যেও বিশেষ স্থান অধিকার করবেন।”